
“অকারণ নিপীড়নই একটি যুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত করেছিল।”- ‘১৯৭১’ উপন্যাস থেকে অন্তত তিনটি চরিত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ‘১৯৭১’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ যে যুদ্ধের কাহিনি দেখিয়েছেন তা মূলত একপক্ষীয় যুদ্ধ। নীলগঞ্জ গ্রামের শান্ত-নিবিড় পরিবেশে যুদ্ধের নৃশংসতা ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মিলিটারি আছে, তাদের দোসর আছে কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী নেই সেখানে। বাঙালি বীরের জাতি বলেই কিনা গ্রামের সাধারণ স্কুলমাস্টার আজিজ, পাকিস্তানিদের সহযোগী হয়েও বাঙালি যুবক রফিক এবং ভীতু প্রকৃতির সফদরউল্লাহর মতো ব্যক্তিরা উপন্যাসে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন। নিচে এই তিনটি চরিত্রের আলোকে পাকিস্তানিদের অকারণ নিপীড়নমূলক যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হওয়ার প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো—
‘১৯৭১’ উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র নীলগঞ্জ প্রাথমিক স্কুলের হেডমাস্টার আজিজ। প্রথমে মেজর এজাজ তার সাথে অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করলেও তার কাছ থেকে কোনো প্রকারের তথ্য না পেয়ে তাকে অমানুষিক অত্যাচারের মুখোমুখি করে। মেজর তাকে মুক্তিবাহিনীর সহযোগী হিসেবে সন্দেহের জের থেকেই তার প্রতি বর্বর আচরণ করে। একপর্যায়ে তার সামনে গণহত্যার মতো নারকীয় দৃশ্যের প্রেক্ষাপট সাজিয়েও যখন তার কাছ থেকে কোনো তথ্য আদায় করতে পারে না তখন মেজর অসম্মানজনক আচরণ আজিজ মাস্টারের সাথে অপমানজনকভাবে বেঁচে থাকা কিংবা মৃত্যু এমনই শর্ত জুড়ে দেয় মেজর। গ্রামে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো দৃশ্যপট, সেই সাথে পুরুষাঙ্গে ইটের বোঝা। এমন অপমান যেকারও জন্যই অপমানের। তাই তো আজিজ মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করে। এখানে স্কুলমাস্টারের উলঙ্গ করার বিষয়টি দেশমাতাকে উলঙ্গ করার শামিল বিবেচনা করেই মূলত আজিজ বিদ্রোহী হয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। শুধু একপক্ষীয় নিপীড়নের কারণেই আজিজ মাস্টারের মতো ব্যক্তিও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
উপন্যাসের রহস্যময় চরিত্র রফিক। নীল শার্ট পরিহিত মেজর এজাজের দোভাষী হিসেবে পরিচিত রফিক। গ্রামের রাস্তাঘাট সবকিছু তার পরিচিত। কিছুটা প্রতীকীভাবেই লেখক তাকে উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসে। হানাদার বাহিনীর সহযোগী হলেও সে গ্রামবাসীর সাথে নমনীয় আচরণ করে, কৈবর্ত পাড়ায় আগুন দিতে মেজরকে নিষেধ করে। নীলু সেনের ভাগ্নে বলাইকে বাঁচাতে চায়, হেডমাস্টার আজিজের সাথে অন্যায়মূলক আচরণের সময় প্রতিবাদ করে। উপন্যাসের শেষাংশে সে একজন বীরের ন্যায় মৃত্যুকে বরণ করে। মেজারের সহযোগী হয়েও সে যে বিদ্রোহের বীজ বুনেছে তা অতুলনীয়। এক্ষেত্রেও বলা যায়, রফিক তার বিবেকবোধ থেকেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কারণ রফিক দেখে যে, পাকিস্তানিরা সহজ-সরল মানুষের প্রতি নিপীড়ন চালায়।
সফদরউল্লাহ আরেকটি প্রতিবাদী চরিত্র। কালবৈশাখি ঝড়ের রাতে রাজাকারদের সহযোগে পাকিস্তানি সেনারা তার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে । লাঞ্ছিত করে। এই অন্যায় সে সহ্য করতে না পেরে দা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অন্যায়কারীদের মূল হোতা সুবাদার ও তার এক সহযোগীর খোঁজে। পৈশাচিক পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসা হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের মঝে সফদরউল্লাহর এই সামান্য প্রতিবাদ প্রমাণ করে যে সেও মুক্তি চায়। হানাদার বাহিনীর এরূপ একপক্ষীয় অত্যাচার তার মধ্যে মুক্তির বাসনা জাগায়।
উপর্যুক্ত তিনটি চরিত্রের আলোচনায় দেখা যায়, তারা ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এভাবেই নিপীড়ন মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে। তাকে মুক্তির জন্য লড়াই করতে বাধ্য করে। তাই বলা যায়, অকারণ নিপীড়নই একটি যুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত করেছিল।